বাংলাদেশের স্থানীয় উন্নয়নে স্থানীয় অর্থব্যবস্থার ভূমিকা আলোচনা কর

বাংলাদেশের স্থানীয় উন্নয়নে স্থানীয় অর্থব্যবস্থার ভূমিকা আলোচনা কর
বাংলাদেশের স্থানীয় উন্নয়নে স্থানীয় অর্থব্যবস্থার ভূমিকা আলোচনা কর

বাংলাদেশের স্থানীয় উন্নয়নে স্থানীয় অর্থব্যবস্থার ভূমিকা আলোচনা কর

  • অথবা, বাংলাদেশের স্থানীয় উন্নয়নে স্থানীয় অর্থব্যবস্থার ভূমিকা বর্ণনা কর। 
  • অথবা, বাংলাদেশের স্থানীয় উন্নয়নে স্থানীয় অর্থব্যবস্থার ভূমিকা উল্লেখ কর।

উত্তর ভূমিকা : নগরবাসীর সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসে গ্রামীণ উন্নয়ন হলো একটি অন্যতম প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মধ্য দিয়ে উভয়ের ভিতর একটি আন্তঃসম্পর্ক স্থাপিত হয়। 

সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উভয়ের সংশ্লিষ্টতা ও উদ্যোগ গ্রামীণ উন্নয়ন কার্যক্রম জোরদার করে তোলে। এ উন্নয়নে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে প্রয়োজন হয় বলিষ্ঠ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের।

বাংলাদেশের স্থানীয় উন্নয়নে স্থানীয় অর্থব্যবস্থার ভূমিকা : নিম্নে বাংলাদেশের স্থানীয় উন্নয়নে স্থানীয় অর্থব্যবস্থার ভূমিকা আলোচনা করা হলো :

১. গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন : সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়নে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। 

প্রশাসনিক পরিবর্তন, বিশেষ করে উপজেলা পদ্ধতি প্রবর্তনের পর এসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম প্রসারিত হয়। 

বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে রাস্তা, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণের পরিমাণ চোখে পড়ার মতো। সারা দেশে তিন হাজারের বেশি ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করেছে। 

পৌরসভা এবং জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ বিভিন্ন ধরনের রাস্তা নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে। 

২. গ্রামীণ ব্যবসা বাণিজ্য বৃদ্ধি : স্থানীয় অর্থব্যবস্থার যথাযথ প্রয়োগের ফলে এর প্রভাব দেখা যায় গ্রামে কর্মসংস্থান ও উপার্জনের পরিবর্তন থেকে। 

আশির দশকের দ্বিতীয়াংশে গ্রামে ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারিত হয়। স্থানীয় অর্থব্যবস্থার প্রয়োগ করে হাটবাজার নির্মাণ ও সংস্কার করায় গ্রামীণ বেচাকেনা বৃদ্ধি পায় ।

৩. কর্মসংস্থান বৃদ্ধি : স্থানীয় অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে পল্লি উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে রাস্তা, সেতু, কালভার্ট, গুদাম ও হাটবাজার নির্মাণ, স্থানীয় পর্যায়ে সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতিসহ ক্ষুদ্রাকার পানিসম্পদ উন্নয়ন কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত করে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং গ্রামে বসবাসকারী মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের অধিকতর সুযোগ সৃষ্টির সুপারিশ করা হয় । 

৪. পানিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন : স্থানীয় অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণ কর্তৃক চিহ্নিত ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ প্রস্তাবিত সর্বোচ্চ এক হাজার হেক্টর বিস্তৃত আবাদি এলাকায় বন্যা ব্যবস্থাপনা, পানি নিষ্কাশন, পানি সংরক্ষণ ও ভূ- উপরিস্থ পানি দিয়ে সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নে বাঁধ, ফ্লুইস গেট, রেগুলেটর ও সেচনালা নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ বা সংস্কার, খাল পুনঃখনন কিংবা খনন ও রাবার ড্যাম স্থাপন করা হয়।

৫. উপার্জন বৃদ্ধি : গ্রামীণ মানুষের অধিকতর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়াতে গ্রাম এলাকায় গড়পড়তা খানাপ্রতি মাসিক উপার্জন নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ৩ হাজার ১০০ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে চলতি দশকের মাঝামাঝি সাড়ে ১৩ হাজার টাকার কাছাকাছি হয়েছে। 

একই সময়ে শহরে প্রায় ৫ হাজার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে সাড়ে ২২ হাজার টাকা অতিক্রম করেছে। গ্রামে গড়পড়তা উপার্জন বৃদ্ধি পায় ১৬ শতাংশের উপরে। অন্যদিকে, শহরে বৃদ্ধির হার থাকে ১৫ শতাংশের নিচে। 

৬. কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়ন : কৃষি উন্নয়নের জন্য স্থানীয় অর্থব্যবস্থার প্রয়োগ করে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো উন্নতমানের বীজ, সার ও কীটনাশক সরবরাহ ও অধিক খাদ্য উৎপাদনে উৎসাহ প্রদান করে। 

মৎস্য চাষ, পশুপালন ও পশুসম্পদ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এছাড়া সেচ প্রকল্প গ্রহণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করে।

৭. জনস্বাস্থ্য রক্ষা : জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা করে। ময়লা আবর্জনা ফেলা, প্রাণী জবাই, গবাদি পশুর গোসল, ময়লা কাপড়চোপড় ধোয়া ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। 

চিকিৎসার জন্য দাতব্য হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে থাকে। এছাড়া হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার পরিকল্পনায় সহযোগিতা করে থাকে।

৮. সামাজিক উন্নয়ন : স্থানীয় সরকারের সংস্থাগুলো নিজস্ব তহবিল থেকে শিক্ষা বিস্তারের ও নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য পরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, বয়স্ক শিক্ষাদান কেন্দ্র ও লাইব্রেরি স্থাপন, জনপথ, রাজপথ ও সরকারি স্থানে আলো জ্বালানো ইত্যাদি করে। 

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে গণসচেতনতা তৈরি করে এবং জুয়াখেলা, মাদকাসক্তি ও অসামাজিক কাজ প্রতিরোধের ব্যবস্থা করে।

১. সরকারি সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ : স্থানীয় অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে স্থানীয় সংস্থাগুলো সরকারি স্থান, উন্মুক্ত জায়গা, উদ্যান ও খেলার মাঠের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ করে। কবরস্থান, শ্মশান, জনসাধারণের সভার স্থান ও জনসাধারণের অন্যান্য সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করে।

১০. অর্থনৈতিক উন্নয়ন : জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কুটিরশিল্প স্থাপন ও সমবায় আন্দোলন পরিচালনা করে থাকে। মহিলা ও শিশু উন্নয়ন, সমাজকল্যাণ, যুব, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে সহায়তা দান করে। আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্যে নিজ উদ্যোগে কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে।

১১. প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহযোগিতা করা : বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ইউনিয়ন পরিষদ দুস্থদের সাহায্য ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানে স্থানীয় পরিষদের সহযোগিতায় বিভিন্ন আশ্রয়স্থল নির্মাণ করা হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ তা দেখভাল করছে।

১২. পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরি : জেলা পরিষদ জেলার পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরি করে। জেলার সকল উন্নয়ন কার্যক্রমের পর্যালোচনা, সাধারণ পাঠাগারের ব্যবস্থা ও এর রক্ষণাবেক্ষণ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা বা সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত নয় এ প্রকার জনপথ কালভার্ট ও ব্রিজের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, সরকার কর্তৃক জেলা পরিষদের ওপর অর্পিত উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ইত্যাদি করে থাকে।

১৩. পশুপাখির খামার তৈরি : স্থানীয় অর্থব্যবস্থা প্রয়োগের মাধ্যমে পৌর এলাকায় গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি পালন, খামার স্থাপন, গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, গবাদি পশু বিক্রি ও রেজিস্ট্রিকরণ, বিপজ্জনক পশু আটক ও হত্যা, পশুর মৃতদেহ অপসারণ ইত্যাদি কাজে সহযোগিতা করে থাকে।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় জনগণ রাষ্ট্রের শাসনকার্যে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। তাই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। 

স্থানীয় অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে নিজস্ব এলাকা থেকে আয় করে সে অর্থ একই এলাকার উন্নয়ন কাজে ব্যয় করা সম্ভব হচ্ছে। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, স্থানীয় উন্নয়নে স্থানীয় অর্থব্যবস্থার ভূমিকা অপরিসীম। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url