জেলা পরিষদের গঠন ও কার্যাবলী আলোচনা করো

জেলা পরিষদের গঠন ও কার্যাবলী আলোচনা করো
জেলা পরিষদের গঠন ও কার্যাবলী আলোচনা করো

জেলা পরিষদের গঠন ও কার্যাবলী আলোচনা করো

  • অথবা, জেলাপরিষদের গঠন ও কার্যাবলি বর্ণনা কর ।
  • অথবা, বাংলাদেশের জেলাপরিষদের গঠন ও কার্যাবলি সম্পর্কে যা জান লেখ।

উত্তর ভূমিকা : বাংলাদেশে জেলা প্রশাসন অঞ্চলভিত্তিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট। জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের যাবতীয় কলাকৌশল ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়। 

এ উপমহাদেশে জেলা প্রশাসনের প্রথম ভিত্তি রচনা করেছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর। জেলাকে অঞ্চলভিত্তিক একক হিসেবে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট মনে করা হয় । জেলা প্রশাসন কোনো স্থিতিশীল সংগঠন নয়; বরং এটি একটি গতিশীল সংগঠন ।

জেলাপরিষদের গঠন : স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভোটে গঠিত হয় জেলাপরিষদ। জেলাপরিষদ সংশোধিত আইন, ২০১৬ অনুযায়ী জেলাপরিষদ গঠিত হবে চেয়ারম্যানসহ ২১ সদস্যের সমন্বয়ে। এ পরিষদে ১৫ জন সাধারণ সদস্য ও পাঁচজন সংরক্ষিত আসনের সদস্য থাকে ।

চেয়ারম্যান : সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সরকার কর্তৃক জেলাপরিষদের চেয়ারম্যানকে নিযুক্ত করেন। এছাড়াও উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ভোট দিয়ে জেলাপরিষদের চেয়ারম্যানসহ ২১ সদস্যের পরিষদ গঠন করে ।

কর্মকর্তা সদস্য : সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সংশ্লিষ্ট জেলায় কর্মরত সরকারি কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক পদাধিকারবলে জেলাপরিষদের কর্মকর্তা সদস্য নিযুক্ত হন। 

তবে জেলাপরিষদের কোনো সভায় কোনো কর্মকর্তা ও সদস্যগণ ভোট দিতে পারেন না। প্রত্যেক জেলাপরিষদের সরকার কর্তৃক একজন বেতনভুক্ত সেক্রেটারি আছেন এবং সব দাপ্তরিক কার্যক্রম তিনি সম্পাদনা করেন ।

প্রতিনিধি সদস্য : সংশ্লিষ্ট জেলার সংসদ সদস্যগণ, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, পৌরসভার মেয়রগণ, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদাধিকারবলে জেলাপরিষদের প্রতিনিধি সদস্য হন।

মনোনীত ও মহিলা সদস্য : মনোনীত ও মহিলা সদস্যগণ সংশ্লিষ্ট জেলায় বসবাসরত পুরুষ ও মহিলাদের মধ্য থেকে সরকার কর্তৃক মনোনীত হন এবং তাদের সংখ্যা প্রতিনিধি সদস্যদের সংখ্যা থেকে বেশি হয় না।

জেলাপরিষদের কার্যাবলি : জেলাপরিষদ দুই ধরনের কার্যসম্পাদন করে। প্রথমত বাধ্যতামূলক ও দ্বিতীয়ত হলো ঐচ্ছিক কার্যাবলি । নিম্নে জেলাপরিষদের কার্যাবলি আলোচনা করা হলো :

বাধ্যতামূলক কার্যাবলি : জেলাপরিষদের বাধ্যতামূলক কার্যাবলি হলো জেলার সব উন্নয়ন কার্যক্রমের পর্যালোচনা করা। এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহ পরিচালনা ও তদারকি করা, বিদ্যালয় স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ, ছাত্রদের জন্য ছাত্রাবান নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্থ মঞ্জুরি প্রদান ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন, স্কুলের শিশু ছাত্রদের জন্য দুগ্ধ সরবরাহ ও খাদ্যের ব্যবস্থা করা, সাধারণ রাস্তাঘাট, কালভার্ট, ব্রিজ নির্মাণ রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়ন, জনসাধারণের ব্যবহারার্থে উদ্যান, খেলার মাঠ ও উন্মুক্ত স্থানের ব্যবস্থা ও তার রক্ষণাবেক্ষণ, মেলা ও প্রদর্শনী অনুষ্ঠান, কর্তব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠান সংরক্ষণ, গবাদি পশুর খোয়াড় নির্মাণ ও পরিচালনা, সরাইখানা, ডাকবাংলো, বিশ্রামাগারের ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণ, কৃষিজাত দ্রব্যাদির উন্নতি সাধন, শিল্পোন্নয়ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যদান, খেয়াঘাটের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, জনস্বাস্থ্যের উন্নতি, পানীয় সরবরাহ, খাদ্যদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও সরকার কর্তৃক আরোপিত অন্যান্য কাজের দায়িত্ব পালন । 

ঐচ্ছিক কার্যাবলি : জেলাপরিষদ বাধ্যতামূলক কাজ ছাড়াও কিছু ঐচ্ছিক কার্যসম্পাদন করে থাকে। নিম্নে ঐচ্ছিক কার্যাবদি আলোচনা করা হলো :

১. অর্থনৈতিক কার্যাবলি : জেলার সব উন্নয়ন কার্যক্রমের দায়ভার জেলাপরিষদকে নিতে হয়। তাই জেলার মধ্যে আদর্শ কৃষি খামার স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ, উন্নত বৃষ্টি পদ্ধতি জনপ্রিয়করণ, উন্নত কৃষি যন্ত্রপাতির সংরক্ষণ ও কৃষকগণকে উচ্চ যন্ত্রপাতি প্রদান এবং পতিত জমি চাষের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ, শস্য পরিসংখ্যান সংরক্ষণ, ফসলের নিরাপত্তা বিধান, বপনের উদ্দেশ্যে বীজের ঋণদান, রাসায়নিক সার বিতরণ ও তার ব্যবহার জনপ্রিয়করণ এবং পশুখাদ্যের মজুত গড়ে তোলা। 

গ্রামাঞ্চলে বনভূমি সংরক্ষণ, ভূমি সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার এবং জলাভূমির পানি নিষ্কাশন, সমবায় আন্দোলন জনপ্রিয়করণ ও সমবায় শিক্ষার উন্নতি সাধন ইত্যাদি কার্যাবলি জেলাপরিষদের অর্থনৈতিক কার্যাবলির অন্তর্গত।

২. জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কার্যাবলি : জেলাপরিষদ জেলার জনস্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ম্যালেরিয়া ও সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ, চিকিৎসা সাহায্য প্রদানের জন্য সমিতি গঠনে উৎসাহ দান, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, মাতৃসদন ও শিশু মঙ্গল কেন্দ্র স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিদর্শন এবং মা ও শিশুদের কল্যাণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ। 

পশুপাখির ব্যাধি দূরীকরণ ও তাদের মধ্যে ছোঁয়াচে রোগের প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ, গবাদি পশুর খামার ও দুগ্ধ খামার স্থাপন ও সংরক্ষণ, হাঁস-মুরগির খামার স্থাপন ও সংরক্ষণ, উন্নয়নের জন্য অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ।

৩. সমাজকল্যাণমূলক কার্যাবলি : জেলাপরিষদকে সমাজকল্যাণমূলক অনেক কার্যসম্পাদন করতে হয়। দুস্থ ব্যক্তিদের কল্যাণসাধন, আশ্রয়দান, এতিমখানা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং রক্ষণাবেক্ষণ, মৃত নিঃস্ব ব্যক্তিদের দাফন কাফনের ব্যবস্থা করা, ভিক্ষাবৃত্তি, পতিতাবৃত্তি, জুয়া, মাদকদ্রব্য সেবন, মদ্যপান, কিশোর অপরাধ এবং অন্যান্য সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ, দরিদ্রদের জন্য আইনগত সহায়তা সালিশি ও আপসের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ, সমাজকল্যাণ ও সমাজ উন্নয়নমূলক কার্যক্রম জেলাপরিষদের ঐচ্ছিক কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত।

৪. সংস্কৃতিবিষয়ক কার্যাবলি : সংস্কৃতিবিষয়ক কার্যাবলি সম্পাদন করা জেলাপরিষদের ঐচ্ছিক কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত। তথ্যকেন্দ্র স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ, ক্রীড়া ও খেলাধুলার উন্নয়ন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে রেডিও, টেলিভিশনের ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ, জাদুঘর ও আর্টগ্যালারি স্থাপন এবং প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা, পাবলিক হল, কমিউনিটি সেন্টার প্রতিষ্ঠা এবং জনসভার জন্য স্থানের ব্যবস্থা করা, বিশেষ দিবস উদ্‌যাপন, শরীর চর্চার উন্নয়ন, প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলার ব্যবস্থা করা, সংস্কৃতি উন্নয়নমূলক অন্যান্য ব্যবস্থা জেলাপরিষদের কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত।

৫. শিক্ষামূলক কার্যাবলি : জেলাপরিষদের ঐচ্ছিক কার্যাবলির মধ্যে শিক্ষামূলক কার্যাবলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ । গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ, ছাত্রাবাস নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্থ মঞ্জুরি প্রদান এবং জেলার সার্বিক উন্নয়নের জন্য অন্যান্য যাবতীয় কাজ জেলাপরিষদ সম্পন্ন করবে। 

৬. উন্নয়নমূলক কার্যাবলি : জেলাপরিষদ স্থানীয় এলাকার উন্নয়ন, রাস্তাঘাট, পুল, ব্রিজ এককথায় যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিভিন্ন বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, স্থানীয় এলাকার মানচিত্র অঙ্কন ও সংরক্ষণ, স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য ও পুনর্বাসনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে নানাবিধ কার্যসম্পাদন করে থাকে।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, জেলাপরিষদ হলো স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সর্বোচ্চ ইউনিট। 

উপর্যুক্ত কার্যাবলি ছাড়াও পানি নিষ্কাশনে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, ভূউপরিস্থ সুপেয় পানির সংরক্ষণ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও অন্যান্য জনহিতকর অত্যাবশ্যকীয় কাজ জেলাপরিষদ করে থাকে। জেলা পর্যায়ের উন্নয়নের জন্য এ সংস্থাটির কোনো বিকল্প নেই।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url