সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন তত্ত্ব আলোচনা কর

সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন তত্ত্ব আলোচনা কর
সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন তত্ত্ব আলোচনা কর

সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন তত্ত্ব আলোচনা কর

  • অথবা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার তত্ত্বগুলো উল্লেখ কর।
  • অথবা, প্রশাসন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কী কী তত্ত্ব অনুসরণ করা হয়? বর্ণনা কর।

উত্তর : ভূমিকা : প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কর্তব্যের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অন্যতম প্রধান কাজ। প্রশাসনে প্রতিনিয়ত অসংখ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। 

বিভিন্ন বিকল্প প্রস্তাবের মধ্য থেকে একটি বেছে নেওয়াই হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, যা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বা অধস্তন কর্মচারী যে কারো কাছ থেকেই আসতে পারে। 

প্রশাসনকে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বলা যেতে পারে। কেননা সংগঠন কাঠামো তৈরি, দায়িত্ব বণ্টন, সমন্বয়সাধন, জবাবদিহিতার পরিবেশ প্রভৃতি বিষয় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।

সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন তত্ত্ব : প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন তত্ত্ব অনুসরণ করা হয় যেগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী করেছে। 

নিম্নে এ তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :

১. যুক্তিসিদ্ধ তত্ত্ব : যুক্তিসিদ্ধ তত্ত্বের প্রবক্তা হলেন নোবেল বিজয়ী হার্বার্ট এ সাইমন। তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে তিনটি স্তরে ভাগ করেন । যথা : 

ক. সমস্যা বিশ্লেষণ, 

খ. বিকল্প বিশ্লেষণ ও 

গ. সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

সাইমন বলেন, “একটি সিদ্ধান্তের সাথে দুটি বিষয় জড়িত। একটি ঘটনা এবং অন্যটি মূল্যবোধ।” ঘটনা বলতে কোনো কাজ সংঘটিত হওয়া বা কোনো বিষয়ের অবস্থাকে বুঝায়। 

বাস্তবতা বা ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করা যায় এবং তা নির্দিষ্টভাবে বর্ণনাও করা যায়। তার মতে, যে সিদ্ধান্তটি সন্তুষ্টি বিধান করে সেটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে তিনি তিনটি স্তরের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা : 

ক. অর্থনৈতিক মানুষ মডেল, 

খ. সামাজিক মানুষ মডেল ও 

গ. প্রশাসনিক মানুষ মডেল । 

২. পর্যায়ক্রমিক তত্ত্ব : পর্যায়ক্রমিক তত্ত্বে সিদ্ধান্ত প্রণয়নকে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার পরিবর্তে কোনো বিশেষ দিক থেকে পর্যায়ক্রমিকভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। 

এ তত্ত্বে ধাপে ধাপে সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণ করতে হয় এবং ধাপগুলো সম্পর্কে খুব ঘনিষ্ঠ হতে হয় যাতে একটি ধাপের সাথে পরবর্তী ধাপের কোনো অসংগতি না ঘটে। এ তত্ত্বে একটি পর্যায় বা অবস্থাকে স্বীকার করেই এর অন্যান্য বিশেষ দিক পর্যায়ক্রমে আলোচনা করা হয়। যেমন—

ক. সমস্যা চিহ্নিতকরণ।

খ. অতীতে এরূপ সমস্যা মোকাবিলার পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ ।

গ. তাৎক্ষণিকভাবে সঠিক বলে প্রমাণিত সমাধানসমূহ বিশ্লেষণ করা এবং

ঘ. সংগঠনের বর্তমান পদ্ধতি এবং প্রতিষ্ঠানকে হঠাৎ করে পরিবর্তন না করেই সমস্যা মোকাবিলা করতে পেরেছে এমন একটি সমাধান বেছে নেওয়া ।

৩. মিশ্র নিরীক্ষা তত্ত্ব : মিশ্র নিরীক্ষা তত্ত্ব পর্যায়ক্রমিক এবং ব্যবস্থা তত্ত্বের সংমিশ্রণ। এরূপ তত্ত্বের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যথা :

ক. যে সমস্যাটি সমাধান করতে হবে তা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বিশ্লেষণ করতে হবে।

খ. সঠিক যে বিকল্প পন্থা অধিকতর কার্যকরী বলে প্রতীয়মান হচ্ছে সেটিকে সুসংহতভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা করা।

এ তত্ত্বটি পর্যায়ক্রমিক তত্ত্ব থেকে শ্রেষ্ঠতর। কেননা এটিতে পূর্ব অভিজ্ঞতার পরিবর্তে বিকল্পের জন্য সৃজনশীল অনুসন্ধানই প্রাধান্য পায় এবং এটি ব্যবস্থা তত্ত্বে উত্তম হিসেবে বিবেচিত হয়।

৪. কার্যগত তত্ত্ব : কার্যগত তত্ত্বকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এ তত্ত্ব গ্রহণ করার সময় কাজের প্রতি বিশেষ লক্ষ রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। 

তবে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় নিশ্চয়তা, অনিশ্চয়তা বা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হয়। কেননা অনিশ্চিত অবস্থায় প্রত্যেকটি বিকল্প প্রস্তাবে অনেক দাবিদাওয়া সংযুক্ত থাকে।

৫. অর্থনৈতিক তত্ত্ব : আধুনিক অর্থনীতির যুগে অর্থ ছাড়া কোনো কিছুই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় । তাই সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিকটিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। 

অন্যথায় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন অসম্ভব এবং এ সিদ্ধান্ত কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকবে। সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বিকল্প কর্মপন্থায় ব্যয় এবং উপকার এ দুয়ের অনুপাত মূল্যায়ন করতে হবে এবং স্বল্প ব্যয়ে কার্যকরী সিদ্ধান্ত বেছে নিতে হবে।

৬. সম্ভাবনা তত্ত্ব : সংগঠনের সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার অনিশ্চয়তা দূরীকরণের লক্ষ্যে ব্যবস্থাপক বা প্রশাসক এ তত্ত্ব উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করেন। 

অনেক দৃষ্টান্ত থেকে দেখা যায়, একজন প্রশাসক বা ব্যবস্থাপক কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলাফল সম্পর্কে কিছু জ্ঞান রাখেন, অর্থাৎ এ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পোষণ করতে পারেন। 

প্রশাসকগণ তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে উৎকৃষ্ট ও সম্ভাবনাময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন যদিও এক্ষেত্রে ঝুঁকি বা অনিশ্চয়তা থেকেই যায় । 

৭. তথ্যগত তত্ত্ব : তথ্যগত তত্ত্ব সংবাদমূলক তত্ত্ব হিসেবে পরিচিত। এ তত্ত্ব বিভিন্ন তত্ত্বের প্রতি গুরুত্বারোপ করে এবং বিশেষভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ওপর প্রভাব সৃষ্টিকারী উপাদান। 

যেমন— প্রক্রিয়া, তথ্য, মূল্যবোধ এবং সিদ্ধান্তের শ্রেণিকরণ ও কোনো বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে গুরুত্বারোপ করে। সংবাদমূলক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার জন্য এটি তথ্যগত তত্ত্ব নামে পরিচিত।

৮. সংগতিকরণ : সংগতিকরণ তত্ত্বানুসারে সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় যুক্তিসিদ্ধ, মানবিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, কর্তৃত্বপূর্ণ এবং স্বশাসিত উপাদানসমূহ একত্র করে যাতে কর্মরত গোষ্ঠীর সব সদস্য পূর্ববর্তী কোনো নির্দিষ্ট ব্যবস্থা থেকে ভালো চেষ্টা করেন। 

এরূপ ব্যবস্থা পদ্ধতি প্রকৃত ঘটনাস্থলে গ্রহণ করা হলে তা অধিকতর কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। ঘটনাস্থলে বা প্রকৃত কর্মস্থলে সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট হলে এবং যথাযথ তথ্য ও অভিজ্ঞতা পাওয়া গেলে সিদ্ধান্ত প্রণয়ন সমস্যার পরিবর্তে সুযোগ হিসেবে প্রতিপন্ন হবে। 

সমস্যা সমাধান ও সিদ্ধান্ত প্রণয়নে যৌক্তিক, নৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উপাদানকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে।

উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও বিভিন্ন ধরনের সংগঠনকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

সংগঠনের লক্ষ্য, আদর্শ, মূল্যবোধ -এবং চিন্তাচেতনা সামাজিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বদা পরিবর্তন হচ্ছে। তাই সিদ্ধান্ত গ্রহণে তত্ত্বসমূহের অধ্যয়ন ও প্রয়োগ এবং প্রয়োজনভেদে পরিবর্তন প্রয়োজন । 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url